বনফুলের গল্প অবলম্বনে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিচয়

কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত বনফুল বাস্তব জীবন ও জ্ঞান – বিজ্ঞানের বিচিত্র উপাদান তাঁর গল্প ও উপন্যাসে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেছে। বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৯৯-১৯৭৯) রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা , আখ্যানবস্তুর সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি , তীক্ষ্ণ মননশীলতা এবং নানারূপ পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে । বনফুলের লেখা ছোটগল্প গুলোকে বাংলা সাহিত্যে এক অপরূপ বিস্ময় বলে মনে করা যায় । এই বিস্ময় কেবল আশ্চর্য বাকসংক্ষিপ্তির কল্যাণেই নয় , শৈলী ও ভাবানুষঙ্গে এমন অনির্বচনীয় রহস্যময়তা বিদ্যমান , যার অদৃশ্য প্রভাবে স্বল্পকথার সর্বাঙ্গ ঘিরে বচনাতীতের এক মৌন স্পর্শ যেন গুঞ্জন করে । গল্পে তার আঙ্গিক চিন্তা ছিল নিয়ত নতুন। বনফুলের গল্পে এমন রচনা সুলভ , যেখানে আপন জীবন অথবা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছেন । সকল সার্থক সৃষ্টির মতই তাঁর সকল লেখা আত্মকথারই ফসল। নতুন কথার সঙ্গে নতুন ধরনের কথা বলার আগ্রহ তাঁর শিল্পীচেতনায় প্রবল ছিল । বনফুলের গল্পে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে বনফুলের গল্প অবলম্বনে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিচয় তুলে ধরা হলো :

বনফুলের গল্প অবলম্বনে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিচয়

ছোটবেলা থেকেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লক্ষ করা যায়। সাহিত্য সাধনায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব কথাশিল্পে। নতুন ধারা ও বিচিত্র ধরণের কাহিনী নির্মাণে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বনফুলের ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্র রূপের প্রকাশ দেখা যায়। জীবন সম্পর্কে যেমন তাঁর কোনো অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না, তেমনি কোনো বিশেষ আদর্শের প্রতিও তাঁর অকারণ অনুরক্তি ছিল না। জীবনকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যতটুকু জেনেছেন, ততটুকুই যথার্থ মহিমার সাথে প্রকাশ করেছেন। সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করা ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের ব্রত। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তাঁর অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এ সেবাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সাধারণ, নিরন্ন, অবহেলিত, শ্রমজীবী মানুষের জীবন আঁকতে চেয়েছেন শিল্পে। তাঁর কাছে এর এক অসাধারণ মাধ্যম ছিল ছোটগল্প। ছোটগল্প রচনায় তিনি তুলনাহীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্ররূপের সমাবেশ ঘটেছে- যেমন গল্পের বিষয়বস্ত্ততে, তেমনি ব্যাপক সৃজনশীলতায়। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের নানা স্ববিরোধিতা, দুর্জ্ঞেয় রহস্য, আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। নিম্নে বনফুলের জীবন পরিচয় ও তাঁর গল্প অবলম্বনে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিচয় তুলে ধরা হলো :

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯)  কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, প্রবন্ধকার। তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে পরিচিত। 

জন্ম : তিনি ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । বলাইচাঁদের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়ালখালায়। 

পিতা : সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার। মাতা: মৃণালিনী দেবী।

শিক্ষাজীবন : বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৮) এবং হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২০) পাশ করেন। একই বছরে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। তবে তিনি যখন  ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণিতে পড়েন, তখন বিহারের পাটনায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিহার থেকে আসা ছাত্র হিসেবে তিনি এ নব প্রতিষ্ঠিত কলেজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখান থেকে এমবিবিএস (১৯২৮) পাশ করেন।

কর্মজীবন : বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে। পরে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ভাগলপুরের খলিফাবাগে নিজ উদ্যোগে 'The Secro-Bactro চলিনিচ' নামে একটি ল্যাবরেটরি  প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতিমান ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি ১৯৬৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।

সাহিত্যজীবন : ছোটবেলা থেকেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লক্ষ করা যায়। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে কবিতা রচনা করেন। সম্পাদনা করেন 'বিকাশ' (১৯১৫) নামে হাতে-লেখা একটি সাহিত্যপত্রিকা। তাতে প্রকাশিত হতো প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, অনুবাদ প্রভৃতি। এ সময় থেকে তাঁর সাহিত্য বিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয় 'ভারতী' (১৮৭৭), 'প্রবাসী' (১৯০১), 'কল্লোল' (১৯২৩) প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায়। 

এসব পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতার নিখুঁত ছন্দ এবং গল্পের বিষয় নির্বাচন ও ভাষার ওপর দক্ষতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় নিসর্গ চেতনা, প্রেম ও আত্ম-উপলব্ধি। কবিতার আঙ্গিক বিবেচনায় লক্ষ করা যায়, তিনি লিখেছেন দীর্ঘকবিতা, গদ্যপদ্যের মিশ্রণজাত কবিতা, সনেট, হাইকু প্রভৃতি। বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ ছিল না; তিনি ছন্দমিলের পুরানো ধাঁচেই কবিতা লিখেছেন। 

বনফুলের কবিতা (১৯৩৬), 

'অঙ্গারপর্ণী' (১৯৪০), '

'চতুর্দশী' (১৯৪০), 

'আহবনীয়' (১৯৪৩), 

'করকমলেষু' (১৯৪৯), 

বনফুলের ব্যঙ্গ কবিতা (১৯৫৮), 

'নতুন বাঁকে' (১৯৫৯) প্রভৃতি তাঁর কাব্য সংকলন।

সাহিত্যসাধনায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব কথাশিল্পে। নতুন ধারা ও বিচিত্র ধরণের কাহিনী নির্মাণে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উপন্যাস লিখেছেন একষট্টিটি, গল্প ছয়শত। তাঁর  উপন্যাসের বিষয়- ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, প্রেম প্রভৃতি। তাঁর উপন্যাসগুলিতে লক্ষ করা যায় মানব জীবনের নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ। যথার্থ শিল্পীর বেদনাবোধ তাঁর সৃজনী প্রতিভায় বিদ্যমান। তিনি বিপুল কৌতূহলী মনে ও সহমর্মিতায় মানব জীবনকে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- 

'তৃণখন্ড' (১৯৩৫), 

'জঙ্গম' (তিন খন্ড, ১৯৪৩-১৯৪৫), ‘

অগ্নি’ (১৯৪৬), 

'ডানা' (তিনখন্ড, যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৫০ ও ১৯৫৫), 

'স্থাবর' (১৯৫১), 

'অগ্নীশ্বর' (১৯৫৯), 

'হাটেবাজারে' (১৯৬১), 

'ত্রিবর্ণ' (১৯৬৩), 

'ভুবনসোম' (১৯৬৩), 

'প্রচ্ছন্ন মহিমা' (১৯৬৭),

'উদয় অস্ত' (দুই খন্ড, ১৯৫৯ ও ১৯৭৪) প্রভৃতি। 

তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের গঠনভঙ্গি স্বতন্ত্র এবং অভিনব। তিনি কাহিনী বর্ণনা করেন কখনও নাটকীয় সংলাপে, কখনও স্বগতোক্তিতে, কখনও কবিতায়। তিনি উপন্যাসের গঠনরীতি এবং কথন-কৌশলে যেসব পরীক্ষা করেন, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'ভূবনসোম'।

সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করা ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের ব্রত। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তাঁর অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এ সেবাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সাধারণ, নিরন্ন, অবহেলিত, শ্রমজীবী মানুষের জীবন আঁকতে চেয়েছেন শিল্পে। তাঁর কাছে এর এক অসাধারণ মাধ্যম ছিল ছোটগল্প। ছোটগল্প রচনায় তিনি তুলনাহীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্ররূপের সমাবেশ ঘটেছে- যেমন গল্পের বিষয়বস্ত্ততে, তেমনি ব্যাপক সৃজনশীলতায়। তাঁর ছোটগল্পে মানবজীবনের নানা স্ববিরোধিতা, দুর্জ্ঞেয় রহস্য, আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়।

ছোটগল্পে বনফুলের জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনা : বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। ছোটগল্প পরিকল্পনায় তাঁর মৌলিকতা, তীক্ষ্ম মননশীলতা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের উপস্থাপন পাঠকের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। আবার এ ধারাতেই তাঁর গল্প জীবনের অভিজ্ঞতায় সরস, গভীর ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য। তাঁর গল্পের অন্য বিশেষত্ব ও অভিনবত্ব হচ্ছে স্বল্প অবয়ব। তাঁর অধিকাংশ গল্প এ সূত্রে বাঁধা বলে এগুলিকে বলা হয় অনুগল্প। বলা যেতে পারে ছোটগল্প রচনায় তাঁর প্রতিভা সম্যকরূপে বিকাশ লাভ করে। 

ছোটগল্প কত ছোট হতে পারে, খন্ডিত বা আকস্মিকতাজনিত অসমাপ্তির বোধ কীভাবে সৃষ্টি না হয় তার পরীক্ষা তাঁর গল্পগুলিতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে গভীর চিন্তা ও জটিল অভিজ্ঞতার নিপুণ প্রকাশ তাঁর ছোটগল্পগুলিকে এক অসাধারণত্ব দান করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ-

বনফুলের গল্প (১৯৩৬), 

'বিন্দুবিসর্গ' (১৯৪৪),

 'অদৃশ্যলোকে' (১৯৪৬), 

'তন্বী' (১৯৪৯), 

'অনুগামিনী' (১৯৫৮), '

'দূরবীণ' (১৯৬১), 'মণিহারী' (১৯৬৩), 

'বহুবর্ণ' (১৯৭৬), 

বনফুলের নতুন গল্প (১৯৭৬) প্রভৃতি।

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নাটক রচনাতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রহসন, একাঙ্কিকা, চিত্রনাট্য, নাটিকা ছাড়াও তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনচরিত অবলম্বন করে নাটক রচনা করেন, যাতে পাওয়া যায় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার অপর একটি ভিন্ন রূপের পরিচয়। উনিশ শতকের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব  মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা তাঁর নাটক, 'শ্রীমধুসূদন' (১৯৪০) ও 'বিদ্যাসাগর' (১৯৪১)। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এ দুটি নাটকের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে এঁদের ব্যাপকভাবে  ও যথার্থরূপে পরিচিত করিয়ে দেন। বাংলা সাহিত্যে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে বলা যেতে পারে এ 

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় আছে সুস্থ জীবনের আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধের চেতনা, অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে ধিক্কার। তাঁর রচনারীতি সুমিত ও সংক্ষিপ্ত, তাঁর দৃষ্টি নির্মোহ ও নিরাসক্ত; জীবনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, তুচ্ছ ও বিরাট সবকিছুর মধ্য থেকে শিল্পের উপাদান সংগ্রহের ক্ষমতা তাঁর রচনাকে দিয়েছে বৈচিত্র্য এবং গভীরতা।

বনফুলের ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্র রূপের প্রকাশ দেখা যায়। জীবন সম্পর্কে যেমন তাঁর কোনো অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না, তেমনি কোনো বিশেষ আদর্শের প্রতিও তাঁর অকারণ অনুরক্তি ছিল না। জীবনকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যতটুকু জেনেছেন, ততটুকুই যথার্থ মহিমার সাথে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সাহিত্যে জীবনরহস্য ও মানবপ্রকৃতির এই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেখে তাঁকে Naturalist বা প্রকৃতিবাদী বলা ভুল হবে না। বস্তুত ফরাসি সাহিত্যে প্রকৃতিবাদ এমিল জোলা কিংবা বালজাকের রচনায় সার্থক রূপ পেয়েছিল। 

সাহিত্য প্রকৃতিবাদের মূল্য কম নয়। জীবনকে তার আপন স্বরূপে ফুটিয়ে তোলার মাঝে অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে। কিন্তু বনফুল এমিল জোলা, বালজাক কিংবা মোপাসাঁর গোত্রের লেখক নন। তাঁকে শুধু জীবনের রূপকারই বলা যায় না, তিনি জীবনের ব্যাখ্যাকারও বটে।

মানুষের আচরণ ও মানব মনের অতল রহস্যের স্বরূপ উদঘাটনে বনফুলের সন্ধানী দৃষ্টি জীবনকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন। তাঁর সচেতন দৃষ্টি অন্বেষণ করেছে জীবনের অন্ধকার গলি, আলোকিত পথ, বহু সর্পিল জীবনের নানা রূপ। ছোটগল্পে বনফুলের শ্রেষ্ঠ কীর্তি গল্পের রূপ-দৃষ্টিতে। গল্প আকারে কতটা ছোট ও হালকা হয়ে জীবনের কত বৃহৎ ও গভীর সত্যকে প্রকাশ করতে পারে, বনফুলের ছোটগল্প তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

তাঁর 'বুধনী' গল্প শুরু হওয়া মাত্রই সমাপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষের ভিতরের যে পাশবিকতা, যে আদিমতা—তার রূপটি তিনি তুলে ধরেছেন এ গল্পে। যে মানুষ ভালোবেসে সব জয় করতে পারে, সে মানুষই হত্যাও করতে পারে। মানব চরিত্রের এই বৈপরীত্যকে তিনি তুলে ধরেছেন। বুধনীকে ভালোবেসে অনেক কষ্টে তাকে জয় করেছে বিল্টু অথচ আপন সন্তানকে জয় করতে পারেনি। ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাওয়ার ঈর্ষায় সন্তানকে হত্যা করেছে সে। গল্পের শেষ না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায়নি যে, বিল্টু শিশু-হত্যাকারী। তবে বিল্টুর অসভ্য আচরণের কিছুটা নমুনা লেখক গল্পের শুরুরদিকেই দিয়েছেন—'সত্য কোন যুবক আলো-ছায়া খচিত মহুয়া তরুতলে কোন কিশোরীকে দেখিলে যে ঔদাসীন্যভরে চলিয়া যাইত, বিল্টু তাহা করে নাই। বন্য পশুর মতো সে তাড়া করিয়াছিল।... অসভ্যটা তাহাকে দেখিলেই তাড়া করিত।'(পৃষ্ঠা ৩৮)

লেখক স্বল্প পরিসরে বন্য সমাজের বিবাহের রীতিও তুলে ধরেছেন এ গল্পে। সেইসাথে বন্য বর্বর মানুষ ও সভ্য সমাজের মানুষের পার্থক্যের মাধ্যমে তীক্ষ্মভাবে সমাজের ব্যবধানকেও ব্যঙ্গ করেছেন।

'ক্যানভাসার' গল্পে স্বামী ভৈরব ও স্ত্রী কাত্যায়নীর কথোপকথনের মাধ্যমে লেখক বুঝিয়ে দেন তাদের দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের কথা। গল্পের হীরালাল ক্যানভাসার হলেও সে-ও রক্ত-মাংসের মানুষ। আবার লেখক বলছেন, ক্যানভাসের কথায় 'ভৈরবের আত্মসম্মানে আঘাত করিল।' অর্থাৎ কাত্যায়নী, ভৈরব, হীরালাল–এরা সকলেই আসলে নিম্নশ্রেণির, তাই বলে তাদের আত্মসম্মানবোধ নাই এমনটাও নয়। ক্যানভাসার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে; নকল দাঁত, নকল গোঁফ লাগিয়ে দাঁতের মাজন ও চুলের কলপের ব্যবসা করে লোক ঠকিয়ে দু' পয়সা উপার্জনের পথে নেমেছে। ভৈরব প্রথমে তা না বুঝলেও, যখন তার চপেটাঘাতে হীরালালের নকল দন্তপাটি ও গোঁফ খুলে গেছে এবং অসহায় হীরালাল তাকে জানায়–'গরিব মানুষ — এই করে কষ্টে-সৃষ্টে সংসার চালাই। বুড়ো বয়সে উপযুক্ত ছেলেটি মারা গেছে—'(পৃষ্ঠা ৫৬) তখন 'হতভম্ব নির্বাক ভৈরবের বাক্যস্ফূর্তি হইলে সে বলিল, আচ্ছা, দিন এক কৌটা মাজন।' (পৃষ্ঠা ৫৬) মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কখনো কখনো অসৎ পথে যায়। 'লালসালু'র মজিদ যেমন নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে অসৎ পথ বেছে নিয়েছিল এ গল্পেও দেখি ক্যানভাসার হীরালাল নকল দাঁত ও নকল গোঁফ লাগিয়ে দাঁতের মাজন ও চুলের কলপের ব্যবসা করছে। শেষে তার চাতুর্য ধরা পড়ে ভৈরবের কাছে। যে ভৈরব প্রথমদিকে হীরালালকে প্রহার করেছে, শেষে দেখি তার ভণ্ডামি দেখেও সে কিছুই বলতে পারেনি বরং অসহায়ের মতো নির্বাকভাবে তাকিয়ে থেকে এক কৌটা মাজন কিনে নেয়। যদি ভৈরব উচ্চশ্রেণির কেউ হতো, তাহলে হয়তো এই আন্তরিকতা না দেখিয়ে ক্যানভাসারকে শাস্তি দিত। এক দারিদ্রই পারে আরেক দরিদ্রের মর্মযাতনা, সংকটকে বুঝতে।

'মানুষ' গল্পের শুরু আছে শেষ নেই। একই সময়ে বিভিন্ন মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে কী করছে বা জীবিকার প্রয়োজনে কোন পথ অবলম্বন করছে, লেখক তা দেখিয়ে দেন। এ গল্পের দুই ভিখারি— রোগগ্রস্ত ও স্বাস্থ্যবতী।  'ব্যাধি ও স্বাস্থ্য পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে—একই উদ্দেশ্য। ক্ষুধার অন্ন চাই।'(পৃষ্ঠা ৬২) স্বাস্থ্যবতী মেয়েটার সৌন্দর্য অবহেলায়া আচ্ছন্ন এবং কীভাবে তার অপব্যবহার হচ্ছে লেখক সেটা বলে দেন—'পথে দেখিলাম, সেই উদ্ভিন্নযৌবনা ভিখারিণী একটা গলির স্বল্প আলোকে দাঁড়াইয়া একটি গুণ্ডা-গোছের লোকের সহিত হাস্য-পরিহাসে মুখর হইয়া উঠিয়াছে।'(পৃষ্ঠা ৬২) এই সময়ে পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে—এভারেস্ট জয়, চীন-জাপান যুদ্ধ, কংগ্রেস, জন্ম-মৃত্যু। এত বড় বড় সংবাদের মাঝে ভিখারিণী মেয়েটার যৌবন যদি গুণ্ডার দ্বারা নষ্ট হয়েও থাকে—সেটা অজানাই রয়ে যাবে। লেখকও সেটা বলতে চান না, কেননা তারও সুসংবাদ আছে—তার অকর্মণ্য ভাইয়ের চাকরি হয়েছে। 'বিদ্যায় বুদ্ধিতে চরিত্রে আমার ভাইটির অপেক্ষা অনেকে শ্রেষ্ঠও ছিল। তবু তাহাদের অতিক্রম করিয়া কেবলমাত্র সুপারিশের জোরে আমার ভাইই চাকরিটি পেয়েছে। এত বড় অবিচারে এতটুকু বিচলিত হইলাম না। উপরন্তু খুশি হইলাম।'(পৃষ্ঠা ৬৩) লেখক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ করে নিজেরই সুবিধাবাদী রূপটাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আবার জৈবতৃপ্তিটাই যে কিছু মানুষের কাছে প্রধান লেখক এটাও দেখিয়ে দেন। এ গল্পে সমস্ত আয়োজন থাকা সত্ত্বেও শুধু একটা সিগারেট নিয়ে কথক জোৎস্নালোকিত আকাশের সৌন্দর্যকেও তুচ্ছ করেছে।

'পাঠকের মৃত্যু' গল্পে দেখা যায় যে বইটা পড়ার জন্য একসময় এই পাঠক সব ভুলে গিয়েছিল। ধার করা বই পড়তে গিয়ে বইয়ের মালিককে কিছুটা বিরক্তই করেছিল, সেই পাঠক দশ বছর পরে একই বই পেয়ে বিরক্ত হয়েছে। দশ বছর আগে বইটা তার কাছে যে আবেদন তৈরি করেছিল, সেই আবেদন আর নেই। রল্যা বার্থ বলেন, Author has death. লেখক মারা গেছেন। একটা গ্রন্থ লেখার পর লেখকের আর মূল্য নেই, বিভিন্ন পাঠকের কাছে সেটার বিভিন্ন আবেদন তৈরি হয়। তেমনি একই পাঠকের কাছে একই গ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন অর্থ তৈরি করে।

'নিমগাছ' গল্পে লেখক বলে দিচ্ছেন যে, একেক মানুষের কাছে নিমগাছ একেকভাবে ব্যবহৃত হয়। কেউ পাতা নিয়ে যায়, কেউ ছাল-বাকল তোলে কিন্তু কেউ কখনো ভাবে না নিমগাছের ভাল লাগা, মন্দ লাগার কিসে কিংবা তার আনন্দ-বেদনাই বা কোথায়! কিন্তু একদিন এক কবি এলো, যে নিমগাছের পাতা বা ছাল-বাকল তোলে না বরং নিমগাছের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়। তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, তিনি নিমগাছের অপার সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন। নিমগাছের যে সুফল কেবলই সেটাকে ভোগ করেন না। (ভোগে প্রয়োজনীয়তা থাকে আর উপভোগে থাকে ভালোলাগা, ভালোবাসা)

নিমগাছটার ইচ্ছে হলো সৌন্দর্যের সেই পূজারীর সঙ্গে চলে যাওয়ার কিন্তু তার উপায় নেই। কেননা, তার শিকড় মাটির ভিতরে অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির সেই বউটিরও একই অবস্থা। সেও দায়িত্ব পালন করে, তার কাজকর্ম দিয়ে সবার কাছে লক্ষ্মী হয়ে উঠেছে —কিন্তু তার আর মুক্তি নেই। লেখক কৌশলে বাড়ির বধূটির অবস্থা তুলে ধরেছেন নিমগাছের রূপকে।

'তাজমহল' গল্পে এক বৃদ্ধ ফকিরের পত্নীপ্রেমের অমর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের ঐশ্বর্য-সমারোহে আমরা মুগ্ধ হই কিন্তু ফকির শাজাহানের পত্নীপ্রেমের মহিমা আমাদেরকে আকর্ষণ করেনা। দুরারোগ্য 'ক্যাংক্রাম অরিস' রোগে তার স্ত্রীর মুখের আধখান পঁচে গেছে, ডানদিকের গালটা নেই, দাঁতগুলো বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে, দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। তবুও বৃদ্ধ স্বামী নির্বিকারভাবে তাকে পিঠে বহন করে। বৃদ্ধ তাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারেনি কিন্তু তার জন্য হৃদয়ের আবেগ মিশিয়ে ভাঙা ইট আর কাদা দিয়ে গড়েছে 'তাজমহল'। সম্রাটের অমর কীর্তির কাছে এই তাজমহল নগন্য, হাস্যকর হলেও ভালোবাসার মূল্যায়নে তা কোনো অংশেই কম নয়।

'গণেশ জননী' গল্পে পশু চিকিৎসক প্রথমে অনেক বড় আশা নিয়ে হাতির চিকিৎসা করতে গেছেন। তার ভাবনা ছিল, যিনি হাতি পোষেণ তিনি নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক। কিন্তু গিয়ে দেখেন পুরাই ভিন্ন রূপ। হাতিটা তাদের কেনা নয়, দানে পাওয়া এই হাতির খাবার জোগাড় করতে তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়। তবুও তারা হাতির চিকিৎসার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। ডাক্তার কোনো রোগ খুঁজে পাননি। হাতি আসলে মালিকের সাথে অভিমান করেছে। শেষে ডাক্তার চলে যাওয়ার সময় কর্তা ডাক্তারকে মাইনে কত দিবে তা জানতে চাইলে ডাক্তার টাকা নিতে রাজি হননি। 'তখন তিনি বারান্দায় গিয়া দণ্ডায়মান এক ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়া নিম্নকণ্ঠে বলিলেন—তাহলে আর টাকা দরকার হবে না পোদ্দার। গয়নাগুলো তুমি ফেরত দিয়ে দাও।'(পৃষ্ঠা ১৭২) আসলে তিনি ডাক্তারের মাইনের জন্য গয়না বন্ধক রাখতে চেয়েছিলেন। এই যে ত্যাগ বাড়ির কর্তা-কর্ত্রী একটা জন্তুর জন্য করছে, এমন ত্যাগ মানুষের জন্যও এখন মানুষ করে না। যন্ত্রযুগের যান্ত্রিকতায় আমরা মানুষগুলোও যেন যন্ত্র হয়েছি—আমাদের মাঝে নেই স্নেহপ্রীতি; আছে হিংসা আর সুবিধাভোগী মানসিকতা। সেখানে একটা পশুর সাথে মানুষের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, সেই পশু তার মালিকের অনুভূতি বুঝছে, গিন্নী যখন রান্না করে সে শুড় দিয়ে হাওয়া দেয়। বাড়ির কর্তাও বলছে যে, তাদের ঘর মানুষের নয়, হাতির ঘর হয়ে গেছে। অর্থাৎ একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, পশুর মাঝেও মানবিক অনুভূতি তৈরি হয়েছে। লেখক বলেছেন, 'মানুষ একাবারে। মান-অভিমান পর্যন্ত করে।'(পৃষ্ঠা ১৭১) গিন্নী রাগ করায় সে অভিমান করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

এই গল্পে একটা নিরেট কাহিনি পাই। শুরুতেই ডাক্তারের কথা, তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন সেসব পাই—শেষে এসে লেখক ডাক্তারের মহানুভবতা দেখালেন। যে ডাক্তার টাকার লোভেই দূরে এসেছে চিকিৎসা দিতে, সে কিনা শেষে টাকা ছাড়াই হাতি পরিক্ষা করেছে। ছোটগল্পের যে বৈশিষ্ট্য তা পুরোপুরি ধারণ করেছে এ গল্পটি।

'অর্জুন মণ্ডল' গল্পে লেখক দেখিয়েছেন মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অনেক অসাধ্যকেও সাধন করতে পারে। অর্জুন তার ইচ্ছাশক্তির জোরেই বয়স পেরিয়ে গেলেও শিক্ষা অর্জন করেছে। এই গল্পে লেখক অর্জুন মণ্ডলের কাহিনি বলেছেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে আরো অনেক উপ কাহিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

হাসপাতালের সিভিল সার্জনের বেড়াতে আসা এবং তার সাথে অর্জুনের কথাবার্তা।

ড্রেসার করিমের কাছে অর্জুনের শিক্ষাগ্রহণ কীভাবে ব্যান্ডেজ পাকাতে হয়—আবার করিম মিয়ার পারিবারিক পরিচয়।

জমিদার পরিবারে তার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেখানেও কিছু ঘটনা ঘটছে।

অর্থাৎ যত ঘটনাই ঘটুক লেখক তার কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না। মূল জায়গায় থাকছে অর্জুন। স্তরে স্তরে সেখানে বিভিন্ন ঘটনা যোগ হচ্ছে— এটাকে বলে আখ্যানধর্মীতা।

লেখক একটা ম্যাসেজ দিচ্ছেন, অর্জুন মণ্ডল অনেক সময় ব্যয় করে, অনেক পরিশ্রম করে একটা সিন্ধুক তৈরি করল কিন্তু সেটা এতটাই বড় যে, যে কাজের জন্য তৈরি করেছে সেটাই হলো না। শেষ পর্যন্ত তার আর তীর্থযাত্রাও হলো না।

লোকটা অনেক অধ্যবসায়ী ছিলেন, অনেক পরিশ্রম করে শিক্ষা লাভ করেছেন কিন্তু শেষে দেখা গেল তার মাঝে পরিমিতিবোধের অভাব। কোন কাজটা কোথায় করা উচিত, কখন থামা উচিত এটা তিনি জানতেন না বলেই তার সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়। এটা একটা শিক্ষনীয় গল্প।

বনফুলের জীবনের মূল ব্রত ছিল সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সেবা করা। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তাঁর অন্যতম মাধ্যম। এর বাইরে তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কথা বলতে চেয়েছেন। ছোটগল্পে স্বল্প পরিসরে স্বল্প কথায় তিনি সে কাজটিই করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি গল্পের গঠনশৈলী নিয়ে পরিক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। গল্পের গঠন কত ভিন্ন হতে পারে তাঁর গল্প পড়লে তা বোঝা যায়।

তিনি ডাক্তার ছিলেন বলে মানুষের মনোজাগতিক বিষয়গুলো বুঝতে পারতেন। আবার সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আলাদা একটা জীবনবোধ ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন মানবদরদী, নীতিবান। তাঁর মধ্যে তিনটি সত্তার সম্মিলন দেখা যায়—ব্যক্তি বনফুল, সাহিত্যিক বনফুল এবং চিকিৎসক বনফুল। তাঁর লেখা গল্পেও এই তিন বনফুলের প্রভাব দেখা যায়।

তাঁর বিশেষত্বের জায়গা হলো গল্পের কাঠামো নিয়ে নিরীক্ষা। তিনি ছোটগল্প, অণুগল্প, লিপিকা, চূর্ণক, রেখাধর্মী গল্প, আখ্যানধর্মী গল্প লিখেছেন।

অণুগল্প হলো একেবারেই ছোট, স্বল্প অবয়বের গল্প। যেমন: 'বুধনী'

লিপিকা হলো লিপি বা চিঠির আদলে লেখা গল্প। 'ঐরাবত', 'একই ব্যক্তি', 'চান্দ্রায়ণ' গল্পে এর কিছুটা প্রভাব আছে।

চূর্ণক: প্রথমদিকে কিছু গল্প কাঠামো ছিল যাতে কাহিনি আছে কিন্তু শুরু বা সমাপ্তি নেই। যেমন: 'নিমগাছ'।

রেখাধর্মী গল্প: কিছু গল্পে কাহিনি যে শুরু হয়েছে এটা বোঝা যায় না, তবে শেষ লাইনটা পুরো গল্পের ম্যাসেজ বুঝিয়ে দেয়। যেমন: 'নিমগাছ', 'সুলেখার ক্রন্দন'।

আখ্যানধর্মী গল্প: এ ধরনের গল্পগুলো স্তরে স্তরে বিন্যস্ত থাকে। যেমন: 'অর্জুন মণ্ডল'।

সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় লাভ করেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে; ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পান পদ্মভূষণ উপাধি (১৯৭৫)। 

পরিশেষে বলা যায় যে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা , আখ্যানবস্তুর সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি , তীক্ষ্ণ মননশীলতা এবং নানারূপ পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে । বনফুলের লেখা ছোটগল্প গুলোকে বাংলা সাহিত্যে এক অপরূপ বিস্ময় বলে মনে করা যায় । এই বিস্ময় কেবল আশ্চর্য বাকসংক্ষিপ্তির কল্যাণেই নয় , শৈলী ও ভাবানুষঙ্গে এমন অনির্বচনীয় রহস্যময়তা বিদ্যমান , যার অদৃশ্য প্রভাবে স্বল্পকথার সর্বাঙ্গ ঘিরে বচনাতীতের এক মৌন স্পর্শ যেন গুঞ্জন করে । বনফুলের গল্পে এমন রচনা সুলভ , যেখানে আপন জীবন অথবা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছেন । সকল সার্থক সৃষ্টির মতই তাঁর সকল লেখা আত্মকথারই ফসল । নতুন কথার সঙ্গে নতুন ধরনের কথা বলার আগ্রহ তাঁর শিল্পীচেতনায় প্রবল ছিল । ফলে বলা যায় বনফুলের গল্পে তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনা সার্থক। 

মৃত্যু : ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন

সহায়ক গ্রন্থ :

১. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য বিরচিত “বঙ্গসাহিত্যাভিধান”, ২য় খণ্ড, ১৯৯০ খ্রি.

২. বনফুল রচনাবলী (ষোড়শ খন্ড), বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৬২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩

 ৩. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ২৪৪।

৪. বাংলাপিডিয়া


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.