ট্র্যাজেডি কাকে বলে? ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণগুলো কী কী? ট্র্যাজেডির গঠন কৌশল আলোচনা করো

অ্যারিস্টটলের ‘পােয়েটিক্স' অবলম্বনে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা, স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আলােচনা করো

‘পােয়েটিক্স' গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন,-'Tragedy, then, is an imitation of an action that is serious and complete in itself, having a certain magnitude, not in a narrative form but in action, with pleasurable accessories, arousing pity and fear, and herewith it accomplishes to Catharsis', 
অর্থাৎ ট্র্যাজেডি হল একটি গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশিষ্ট আয়তনযুক্ত ক্রিয়ার অনুকরণ। ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়, আর এই ক্রিয়া ভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্যে দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলির পরিশুদ্ধি ঘটায়'। 
এই সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে ট্র্যাজেডির যে বৈশিষ্ট্যগুলি নিরূপিত হয় তা এই রকম,
ক. ট্র্যাজেডি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবলম্বন করে রচিত হয়। কোনাে লঘু বিষয় এর উপজীব্য হতে পারে না। 
খ, এটি হবে আদি-মধ্য–অন্ত্য সমন্বিত একটি কাহিনী। ট্র্যাজেডির আকার তুলনামূলকভাবে বড় হয়েই থাকে। 
গ. ট্র্যাজেডির ঘটনা উপস্থাপিত হয় নাটকীয় ভঙ্গীতে, বর্ণনাত্মক রীতিতে নয়। 
ঘ.ট্র্যাজেডির ভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে থাকে। ভাষার সৌন্দর্যের প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল শব্দ, বাক্য,ছন্দ, সঙ্গীত ইত্যাদির সুললিত ব্যবহারের কথা বলেছেন। 
ঙ. ট্র্যাজেডি পরিণামে পাঠকর মনে করুণা ও ভীতি জাগিয়ে তুলবে। কোনাে মহৎ ব্যক্তির পতনের ঘটনা দর্শনে ৰা পাঠেই দর্শক বা পাঠকের মনে করুণা ও ভয়ের সঞ্চার ঘটবে।
চ. ট্র্যাজেডির পরিণামে অ্যারিস্টটল Catharsis এর উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ পরিশুদ্ধি বা মােক্ষণ। ট্র্যাজেডি দেখলে বা পড়লে মনের মধ্যে একটি পরিশুদ্ধির ভাব জেগে ওঠে। ট্র্যাজেডির | রসােত্তীর্ণর্তার অভিজ্ঞান এই ক্যাথারসিস।
ট্র্যাজেডির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে এর মধ্যে ছয়টি উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই ছয়টি উপাদান হল, 
  • কাহিনী বা Plot, 
  • চরিত্র বা Character,
  • রচনীতি বা Diction, 
  • অভিপ্রায় বা thought, 
  • দৃশ্যসজ্জা বা Spectacle ও 
  • সঙ্গীত বা Melody. 
বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, 
ক. কাহিনী বা Plot: অ্যারিস্টটলের মতে কাহিনীবৃত্ত বা Plot ট্রাজেডির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাহিনীবৃত্তকে ট্রাজেডির আত্মাও বলা চলে। ট্র্যাজেডি হল ঘটনার অনুকরণ। সেই ঘটনাটি বিধৃত হয় কাহিনীবৃত্তে। ট্র্যাজেডির কাহিনীর মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যিক বলে অ্যারিস্টটল মনে করেছেন, যেমন, 
আয়তন - ট্রাজেডির কাহিনী একটি নির্দিষ্ট আয়তনবিশিষ্ট হবে। ঘটনার আদি , মধ্য, অন্ত্য সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করা যাবে। কাহিনী এতটা সংক্ষিপ্ত হবে না যে সেখানে কাহিনীর এই পর্যায়গুলিকে উপলব্ধি করতে বাধা হয়। আবার কাহিনী এতটা বড় আকারেরও হবে না যাতে ঘটনার ঐক্যের উপলব্ধি বিঘ্নিত হতে পারে।
ট্র্যাজেডি কাকে বলে? ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণগুলো কী কী? ট্র্যাজেডির গঠন কৌশল আলোচনা করো
সমগ্র - ট্র্যাজেডির কাহিনী তার অঙ্গ - প্রত্যঙ্গগুলি নিয়ে একটি সমগ্রতায় বিধৃত হবে। Organic whole এই উপলব্ধি ট্র্যাজেডির কাহিনী সম্পর্কে গড়ে ওঠা দরকার। 
ঐক্য - ট্র্যাজেডির ঘটনার মধ্যে স্থান - কাল - পাত্র এই ত্রিঐক্যের সমন্বয় প্রত্যাশা করা হয়। 
বিপ্রতীপ - ট্র্যাজেডির ঘটনার মধ্যে একটা বিপ্রতীপতা লক্ষ্য করা যায়। ট্র্যাজেডির নায়ক চরিত্রে উচ্চ অবস্থান থেকে অকস্মাৎ পতিতি হন। 
উদঘাটন - ট্র্যাজেডির নায়ক চরিত্র অকস্মাৎ তার কোনাে অজানা বিষয় সম্পর্কে অবহিত হন। এটিকে উঘাটন বলা হয়। 
উপকাখিী - ট্র্যাজেডির মূল কাহিনীর সঙ্গে উপকাহিনীও সংযুক্ত থাকতে পারে। 
খ. চরিত্র: কাহিনীবৃত্তের পরেই ট্র্যাজেডির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল চরিত্র। কাহিনীকে চরিত্রেরাই মূর্ত করে তােলে। কাহিনীর সঙ্গে চরিত্রের ওতপ্রােত যােগ থাকাই বাঞ্ছনীয়। চরিত্রগুলিকে সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল হতে হয়। আর ট্র্যাজেডির নায়ক চরিত্রকে অবশ্যই হতে হবে বীর, ওজস্বী ও
ক্ষমতাবান। তাদের সংলাপও হবে অসাধারণ। ট্র্যাজেডির চরিত্রগুলি হবে স্বাভাবিক, প্রথাসিদ্ধ, সঙ্গতিময়। আদর্শ ট্র্যাজিক চরিত্র সম্পর্কে আরিস্টটল জানিয়েছেন যে, আমাদেরই মত দোষে গুণে ভরা একজন সাধারণ মানুষই ট্রাজিক নায়কের পক্ষে উপযুক্ত। কোনাে ধর্মাত্মা বা খল চরিত্রকে অবলম্বন কে ট্রাজেডির রসপরিণাম সিদ্ধ হওয়া সব নয়। কেননা, তাতে করুণ ও উতির অনুভূতির নির্ধারিত উচ্চতায় নিঃসরণ সম্ভব হয় না। অতি ভালােত্ব বা অতিখাৱাপাত্ব দ্বারা আমাদের নৈতিকতাবােধ ও অনুভূতি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মত দোষগুণ যুক্ত হলেও ট্র্যাজেডির নায়ক চরিত্রটি মহনীয় তার দ্বারাই চিহ্নিত হবে। তার একটি ক্রটির দ্বারাই তার জীবন চরম দুর্ভাগ্যে পতিত হবে। তার মহনীয় জীবনে নিয়তির দ্বারা যে দুর্ভাগ্য সূচিত হল তার ফলেই নাটকের ট্র্যাজেডি সম্ভাবিত হয়েছে। 
গ. রচনারীতি: রচনারীতি বলতে রচয়িতা কীভাবে ট্র্যাজেডি লিখবেন তার জন্য অ্যারিস্টটল বিভিন্ন রীতির কথা বলেছেন। কিভাবে বিষয়টি উপস্থাপনা করা হবে তা বলা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কাহিনী যদি ভালোও হয় আর তার উপস্থাপনা যদি খারাপ হয়, তাহলেও নাটক ফলপ্রসূ হতে পারে না। এখানে অখ্যানের মঞ্চ উপস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে না। মূলত কাহিনী বিশ্লেষণ ও ভাষাবন্ধ অর্থাৎ ব্যাকরণের নিয়মনীতি, ছন্দের ব্যবহার, অলংকার প্রণয়ন, উপমার সৌকর্য ইত্যাদির কথা বলা হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলি ট্র্যাজেডির রূপনির্মাণ করে। গ্রিক ট্র্যাজেডির প্রথমদিকে কোরাসের ভূমিকা নাটকে অতি ব্যাপক ছিল। সেজন্য চরিত্রের সংখ্যা তখন কম ছিল। পরে ইস্কাইলাস চরিত্রের গুরুত্ব কিছু বাড়িয়ে দেন। কোৱাসের ভূমিকা কিছু কমে আসে। পরে সফেব্রুসের হাতে এই বিষয়টির আরও পরিবর্তন ঘটে। চরিত্রের গুরুত্ব বাড়ে। কোরসের ভূমিকা কমে আসে। এটিকে রচনাৱাতির একটি বিশেষ দিক বলা যেতে পারে। আবার ট্র্যাজেডির আবহ তার ভাষার মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। 
ঘ. অভিপ্রায়: এই উপাদানটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিপ্রায় কথার অর্থ হল নাট্যকার তাঁর নাটকের মাধ্যমে কী বলতে চাইছেন। নাট্যকার তাঁর নাটকের চরিত্র ও ভাষার সাহায্যে এই অভিপ্রায় ফুটিয়ে তােলেন। নাট্যকারের মননশীলতা এই অভিপ্রায় শব্দটির দ্বারা নির্দেশিত হয়। মহৎ চিন্তাশক্তি দ্বারাই মহৎ কাজ হওয়া সম্ভব। শুধু ট্র্যাজেডি নয়, সমস্ত সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেই এইকথাটি প্রযােজ্য। ট্রাজেডি রচনার সময় নাট্যকার তাঁর ট্র্যাজেডির উপযােগী সমস্ত প্রকরণ নির্ণয় করবেন, এই কাজটি করতে গেলে তাঁকে বহুবিধ চিন্তভাবনার সম্মুখীন হতে হবে। তাঁর সঠিক চিন্তাই তাঁকে ট্রাজেডির সার্থক পরিণামের দিকে অগ্রসর করবে। যেমন, গুয়দিপাউস নাটকের সামগ্রিক পরিকল্পনায় নাট্যকার সফোক্লেসের ট্র্যাজেডির অনুকূল অভিপ্রাহিতার ছাপ স্পষ্ট। সফোক্লেসের নাট্য অভিপ্রায়ের সততার কারণেই ওয়দিপাউস নাটকের মধ্যে মানুষ তার জীবনে নিয়তির পীড়নের ভয়ংকর ও নিয়তির কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের ট্র্যাজেডি উপলব্ধি করতে পারে। 
ঙ. দৃশ্যসজ্জা: এটি নাটকের বহিরঙ্গীণ উপাদান। নাটকের ক্ষেত্রে দৃশ্যসজ্জা নাটকের উপস্থাপনাকে অভিনব করে তােলে। তবে এটি নাট্যকারের বিষয় নয়। মূলত আলংকারিকেরাই এই কাজ করে
চ, সঙ্গীত: সঙ্গীত হল ট্র্যাজেডির সবচেয়ে প্রীতিকর উপাদান। এর দ্বারা নাটকের ধ্বনিবিন্যাসকে অ্যারিস্টটল চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। শ্রীকে ছিলেন গীতবাদের খুব ভক্ত। তাই কোরাসের মাধ্যমে তারা নাটকে সীহের অবতারণা করার কথা ভেবেছিলেন।
এছাড়াও অ্যারিসটটল ট্র্যাজেডির চারটি শ্রেণীবিভাগের কথাও উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল, জটিল ট্র্যাজেডি, যন্ত্রণার ট্র্যাজেড়ি, চরিত্রের ট্র্যাজেডি ও দৃশ্যের ট্র্যাজেডি। অ্যারিস্টটলের মতে জটিল ট্যাজেডি হল সর্বোৎকৃষ্ট। বিপর্যাস ও টনটিনের দ্বারা ক্যাথারসিসের একটি অসাধারণ পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে। যেমন, সফেব্রুসের ওয়দিপাউস নাটক। যন্ত্রণার ট্রাজেড়িতে উৎকণ্ঠা ও ভয়াবহতার দ্বারা পীড়াদায়ক একটি কাহিনী উপস্থাপনা করা হয়। আজাকস, ইফজিওন প্রভৃতি নাটককে এইধরনের ট্র্যাজেডির নিদর্শন রূপে অ্যারিস্টটল উল্লেখ করেছেন। দৃশ্যের ট্র্যাজেডি বলতেও পীড়াদায়ক দৃশ্যের উপস্থাপনা দ্বারা বীভৎসতা কিংবা বিস্ময় সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এখানে দৃশ্যের অতিশায়নের দ্বারা দর্শকের মনে আতঙ্ক বা শিহরণ সৃষ্টি করা হয়। যেমন, ফোরকিদেস বা প্রমিথিউস নাটক। কিন্তু এই জাতীয় নাটক তাৎক্ষণিক আবেদন কিছু সৃষ্টি করলেও দর্শকমনে স্থায়ী অভিঘাত সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয় না। চরিত্র প্রধান যে সমস্ত নাটক, সেখানে সংঘটিত ট্র্যাজেড়িকে আৱিস্টটল চরিত্রের ট্র্যাজেডি বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যারিস্টটল এই শ্রেণীর ট্র্যাজেড়ি বলতে পথিওতেদেস, পেলেউস এইসব নাটকের কথা বলেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে ভীতিও করুণার উদ্রেক এই ধরনের ট্রাজেড়িতে খুব একটা ঘটে না। এই নাটকগুলি অনেকটা জীবনীর মত।
DR. NILANJANA BHATTACHARYYA 
ASSOCIATE PROFESSOR, 
DEPT. OF BENGALI, 
NARAJOLE RAJ COLLEGE
Bengali (PG), Semester-IV, Paper. BENG -403,

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.