বাংলা উপন্যাসে ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ অবদান

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ অসংখ্য ক্ষণজন্মা লেখকের অবদানের ফলে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এই ক্ষণজন্মা লেখকদের মধ্যে ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়’ অন্যতম। তাঁরা বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছে। তাঁরা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন নতুন সুর, নতুন মাত্রা। তিনজনের জগৎ আলাদা, তবে শক্তিতে তারা স্বগোত্রীয়। তাদের উপন্যাসে উঠে এসেছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ব্যক্তি জীবনের যোগ,  আঞ্চলিক জীবনবোধ ও সামন্তচেতনা, জীবন-প্রকৃতি-দর্শন প্রভৃতি, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। নিম্নে বাংলা উপন্যাসে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান তাদের পরিচয়সহ তুলে ধরা হলো:

তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় :  বাংলা সাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৮-১৯৭১) এবং মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)। তাঁরা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন নতুন সুর, নতুন মাত্রা। তিনজনের জগৎ আলাদা, তবে শক্তিতে তারা স্বগোত্রীয়। মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায়ের   , তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঞ্চলিক জীবনবোধ ও সামন্তচেতনা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-প্রকৃতি-দর্শন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। 

বাংলা উপন্যাসে ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ অবদান, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৮-১৯৭১) এবং মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায়
https://www.banglasahitta.com

সাধারণ আলোচনা : বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বেকারত্ব, হতাশা, দারিদ্র্য লক্ষ করে এসময়ের তরুণ সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-কল্যাণের জগতের বিপরীতে অনাহারক্লিষ্ট, কুৎসিত, বিপর্যস্ত পৃথিবীকে সাহিত্যে রূপায়িত করেন। একদিকে ইংরেজদের শাসন-অত্যাচার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, সারাবিশ্বে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজস্ব শিল্পসাহিত্যে থমকে থাকা ভাব। 

এসময় দীনেশরঞ্জন দাস, মানবেন্দ্রনাথ বসু, গোকুলচন্দ্র নাগ ও সুনীতা সেন মিলে ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ নামে একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করতেন। এই ক্লাবটিতে সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও নাটক নিয়ে নিয়মিত আলোচনা ও চর্চা করা হতো। ১৯২২ সালে তাঁরা ‘ঝড়ের দোলা’ নামে একটি ছোটগল্প সংস্করণ বের করেন। 'ঝড়ের দোলা’র প্রেরণা নিয়েই ১৯২৩ সালে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশচন্দ্র দাস ‘কল্লোল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা গড়ে তোলেন। যদিও মাত্র ৭ বছর (১৯২৩-১৯৩০) পর্যন্ত পত্রিকাটি টিকে ছিল, কিন্তু ধারা পরিবর্তনে পত্রিকাটির প্রভাব অনস্বীকার্য। এসময়ের অন্যান্য সাময়িক পত্রিকা যেগুলো 'কল্লোল' পত্রিকাকে অনুসরণ করে সেগুলো হলো – 'উত্তরা' (১৯২৫), 'প্রগতি' (১৯২৬) এবং 'কালিকলম' (১৯২৬)। 'কল্লোল' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসময়ের সাহিত্যিক গোষ্ঠীই 'কল্লোলগোষ্ঠী' নামে পরিচিত। কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা। 

যে সময়ে কল্লোলের আবির্ভাব, তখন বাংলা সাহিত্যের সর্বকোণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাবে প্রোজ্জ্বল। কল্লোল যুগের লেখকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে এসে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা। রোমান্টিক আবেগের বদলে জীবনসংগ্রামের চিত্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি সহানুভূতি, নরনারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত প্রকাশভঙ্গি, শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ মিলিয়ে যে নিরেট মানুষ, তার জীবনযাপনের স্বরূপ উদঘাটনই  কল্লোল যুগের বিশেষ অবদান।

'তিন বন্দ্যোপাধ্যায়' খ্যাত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মানিক  বন্দ্যোপাধ্যায়ও 'কল্লোলগোষ্ঠী'র লেখক ছিলেন। তবে সাহিত্যিক মূল্যায়ন ও জীবন দর্শনের বিচারে তাঁরা 'কল্লোলগোষ্ঠী'র লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)

বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ অন্যতম। তিনি বাংলা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, উপন্যাসকে করেছে প্রাণবন্ত। নিচে তার পরিচয় ও উপন্যাসে অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :

জন্ম : ১৮৯৪ সালের, ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার, মুরারিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে। 

পিতা : মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং  মাতা : মৃণালিনী দেবী। 

মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পণ্ডিত, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য দখল ছিলো তাঁর। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে তিনি কথকতার পালা লিখতেন। সেই পালা গেয়ে খ্যাতিও লাভ করেন। তাঁর গানের গলা যেমন মিষ্টি ছিলো তেমনি অসংখ্য গানও রচনা করেছিলেন তিনি। 'ভুবনমোহিনী' নামে একটা নাটকও লিখেছিলেন তিনি। তাঁর এই সাহিত্য চর্চাই বোধ হয় শৈশবে বিভূতিভূষণকে অনুপ্রাণিত করেছিলো।

শিক্ষাজীবন : নৈহাটির অপর পারে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় বিভূতিভূষণের শিক্ষাজীবন শুরু। আমরা জানি, 'পথের পাঁচালী'র অপুও প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তে যেতো। এখানকার পাঠ শেষ করে তিনি পিতার সাথে ব্যারাকপুর গ্রামে আসেন এবং ১৯০৮ সালে “বনগ্রাম ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে” ভর্তি হন। ভর্তি হবার পয়সাও ছিলো না তখন। দরিদ্র মায়ের রুপার গহনা বিক্রি করে পয়সা সংগ্রহ করেন তিনি। 

১৯১৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর কলকাতায় এসে “রিপন কলেজে” ভর্তি হন। ১৯১৬ তে আই.এ এবং ১৯১৮ তে বি.এ পাশ করেন। 

কর্মজীবন : ১৯১৯ সালে জাঙ্গীপাড়া মাইনর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২০ সালে শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফেরেন। 

১৯২৩ সালে কলকাতার সে সময়ের বিখ্যাত 'অমৃতবাজার' পত্রিকায় 'প্রাইভেট সেক্রেটারি চাই' বিজ্ঞাপন দেখে তিনি আবেদন করেন। এসময় 'প্রবাসী' পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকদিন গল্প প্রকাশ হয় এবং তিনি চাকরির আবেদন পত্রে তা উল্লেখ করায় চাকরিটি পান। বিজ্ঞাপনদাতা ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার অক্ষয় ঘোষ। অক্ষয় ঘোষ তাকে জমিদারির ম্যানেজার করে পাঠান ভাগলপুর স্টেটে। 

এখানকার প্রকৃতি,পরিবেশ ও মানুষজন তার লেখক হয়ে ওঠার দ্বারপ্রান্ত খুলে দেয়। প্রকৃতির কোলে দীর্ঘকাল নির্জনবাসের ফলে তিনি গভীর উপলব্ধির সম্মুখীন হন। তাঁর 'পথের পাঁচালী', কিংবা 'আরণ্যক' লেখার প্রেরণা এই প্রকৃতি।

সাহিত্য জীবন : তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা 'উপেক্ষিতা' নামে একটি ছোটোগল্প। এটি ১৩২৮ বঙ্গাব্দ 'প্রবাসী' পত্রিকায় বের হয়।

তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে -

অপু নামের একটি ছেলের জীবন কাহিনী। একদিকে তার প্রকৃতি প্রেম, গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরের প্রতি আকর্ষণ অন্য দিকে বাইরের পৃথিবীকে দেখার ইচ্ছা। অপুর সঙ্গে সঙ্গ দিয়েছেন - দিদি- দূর্গা , পিতা-হরিহর , মাতা -সর্বজয়া  এবং পিসি ইন্দিরঠাকরুণ।

উপন্যাসটির ৩ টি অংশ -

১.ব্ল্লালীবলাই -অপুর পূর্ব বংশের পরিচয়। 

২.আম আটির ভেঁপু-অপুর গ্রাম্য জীবনের আলোচনা। 

৩.অক্রুর সংবাদ-দিদিকে হারিয়ে পিতা-মাতার সঙ্গে কাশি যাত্রা।

উপন্যাসটিতে নতুনত্ব:

১. বাংলার প্রকৃতির বর্ণনা। 

২. গ্রাম্য মানব জীবনের বিচিত্ররূপ। 

৩. শিশু মনের কল্পনাচরিতা।  

তাঁর 'অপরাজিতা' উপন্যাসটি  ১৯৩২ সালে প্রকাশ হয়। এটিকে  'পথের পাঁচালী'র পরবর্তী অংশ হিসাবে ধরা হয়। এতে অপুর কৈশর ও যৌবনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অপর্ণার সঙ্গে অপুর  বিয়ে, অপুর কলকাতার জীবন , পুত্র কাজলের জন্ম ও অপর্ণার মৃত্যু, সবশেষে পুত্র কাজলকে ছোট বেলার সাথী রানুদির কাছে নিশ্চিন্দিপুরে রেখে অপু বের হয় বহির্বিশ্ব ভ্রমণে।

তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসটি প্রকাশ হয় ১৯৩৯ সালে। সত্যচরণ স্কুল মাস্টারের চাকরি খুইয়ে কলকাতায় আসে এবং ধনী জমিদার বন্ধুর জমিদারি স্টেটের ম্যানেজার পদে যোগ দেয়। উত্তর বাংলা ও বিহারের সীমানায় গঙ্গার ধারে  জঙ্গল মহলের জমি , জমিহীন লোকেদের মধ্যে জমি বিলির জন্য সত্যচরণ  সেখানে যায়। জনগণ অরণ্য ধ্বংস করে বসতি স্থাপন শুরু করে। সত্যচরণ অরণ্য ধ্বংসের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে।

যে কারণে  উপন্যাসটি বিখ্যাত -

১.বনাঞ্চলের নৈসর্গিক দৃশ্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

২.উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে রয়েছে অরণ্যবাসী মানুষের  ছোট ছোট  ঘটনার প্রবাহ ধারা।

৩.নৃত্যশিল্পী বালক ধাতুরিয়া, তরুণী ভানুমতী, সাঁওতাল রাজ ধব্রু পান্না - চরিত্রগুলি অরণ্যের জীব-জন্তুর মতই সহজ সরল।

বোমাইবুরুর জঙ্গলে অল্প বয়সী জিনপরী,  মহিষের দেবতা -`টারবারো' প্রভৃতি লোকদেবতার কল্পনা উপন্যাসে এনেছে ভিন্ন আমেজ।

লেখক উপম্যাসের শেষে বলেছেন "ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরী  নহে , ইহা উপন্যাস”। কিন্তু আঙ্গিকের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় ইহা ডায়েরি, ভ্রমণকথা ও আত্মজীবনী মূলক উপন্যাসের মিশ্রণ। 

'ইছামতী' - ১৯৫০ সালে প্রকাশ। প্রধান কয়েকটি চরিত্র হলো -ব্যবসায়ী লালু পাল, গ্রাম্য বধূ তুলসী, কুঠির কর্মচারী প্রসন্ন চক্রবতী। এ উপন্যাসটিতে লেখক ‘ইছামতি’ নদীর সাথে সম্পর্ক যুক্ত একটি কাহিনির মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ কাল : ১৮৬৩-৬৪ র আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। 

আঙ্গিক নির্মাণের একটি গঠনগত দিক হলো- উপন্যাসটিতে  কোনো পরিচ্ছদ বা বিভাগ নেই। ঐতিহাসিক ঘটনার সহিত যুক্ত তিতুমীর, ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ, লর্ড মেয়ো,  ছোটলাট স্যার উইলিয়াম গ্রে চরিত্র এখানে রয়েছে। আবার নীলবিদ্রোহ, পাঠান কর্তৃক লর্ড মেয়ো হত্য,  স্যার জন লরেন্সের জাহাজডুবি, গ্রাম অঞ্চলে রেললাইন স্থাপন প্রভৃতি ঘটনা রয়েছে।

লোকসংস্কৃতির চিহ্ন  হিসেবে গান ও প্রবাদ প্রবচন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলো হলো: 'চাঁদের পাহাড়' (১৯৩৭), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০), 'বিপিনের সংসার' (১৯৪১) 'দেবযান' (১৯৪৪) 'অথৈ জল'(১৯৪৭), 'অশনি সংকেত' (১৯৫৯) প্রভৃতি। 

ভ্রমণ কাহিনী: 'অভিযাত্রিক' (১৯৪১), 'বনেপাহাড়ে' (১৯৪৫)

ডায়েরি /দিনলিপি: 'স্মৃতির রেখা' 

তার এই সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যেকে এক নতুন দিশায় নিয়ে এসেছে। তার উপন্যাসে জীবন-প্রকৃতি-দর্শন ফুটে উঠেছে খুব গুরুত্বের সহিত। ফলে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। মহান এই সাহিত্যিক ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের  মধ্যে অন্যতম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, উপন্যাসকে করেছে প্রাণবন্ত। 

জন্ম :  ১৮৯৮ সালে,  ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রাম,  বিলীয়মান সামন্ত সমাজের এক ক্ষুদ্র জমিদার পরিবারে।  

পিতার নাম : হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম : প্রভাবতী দেবী। 

তাঁর পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও পিসি শৈলজা ঠাকুরাণী ছিলেন তারাশঙ্করের ভাষায় ‘সেকালের প্রতিনিধি'। পক্ষান্তরে মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সমর্থক বিদুষী মহিলা। এক দিকে ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল।বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত পালিত হন। 

শিক্ষাজীবন : ১৯১৬ সালে স্বগ্রামের ‘যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতার ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে’ আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর  অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। পরে তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন (১৯৩০)। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে কাটিয়ে ১৯৪০ সালে তিনি স্থায়িভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।

সাহিত্যকর্ম : তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা 'কল্লোল'-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া 'কালিকলম', 'বঙ্গশ্রী',  'শনিবারের চিঠি',  'প্রবাসী', 'পরিচয়' প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।

প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে - ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু।

মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নিজে জমিদারবংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এ নীরব পরিবর্তন তাঁর রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন।

তারাশঙ্কর প্রায় দু'শ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে 'চৈতালী ঘূর্ণি' (১৯৩২), 'ধাত্রীদেবতা' (১৯৩৯), 'কালিন্দী' (১৯৪০), 'গণদেবতা' (১৯৪৩), 'পঞ্চগ্রাম' (১৯৪৪), 'কবি' (১৯৪৪), 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা' (১৯৪৭), 'আরোগ্য নিকেতন' (১৯৫৩) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

'চৈতালী ঘূর্ণি' এই উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র চাষী গোষ্ঠী আর তার স্ত্রী দামিনী গ্রাম্য শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরে আসে। গোষ্ঠ কারখানায় চাকরি পায়। স্বামী-স্ত্রী বস্তিতে থাকে। গোষ্ঠ মজুরদের ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে, যার সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কর্মীরাও জড়িত ছিল। তারাশঙ্কর বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন বক্তব্য নিয়ে আসেন।

‘ধাত্রী দেবতা' উপন্যস রচনা করে তারাশঙ্কর ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাসকে শিল্পের মহিমা দান করেন। আইন অমান্য আন্দোলনকালে নিজের কারাবরণকে শিবনাথের আত্মকথায় ধাত্রীদেবতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

'কালিন্দী': রায়হাট গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কালিন্দী নদীতে (ব্রাহ্মণী স্থানীয় নাম) জেগে ওঠা নতুন চরের মালিকানা স্বত্ব নিয়ে দুই জমিদার পরিবারের অন্তর্কলহকে কেন্দ্র করে তার কালিন্দী উপন্যাস রচিত হয়েছে। সাঁওতালদের অকৃপণ শ্রমে কালিন্দীর চর যখন ‘স্বর্ণ প্রসবিনী' তখন এ চরটির মালিকানা স্বত্বের দাবি প্রতিষ্ঠায় রায় বংশ ও চক্রবর্তী বংশের মধ্যকার ঐতিহ্যিক দ্বনদ্ব নবরূপে বিকশিত হলো। কিন্তু তৃতীয় এক পক্ষের আগমনে স্বশ্রেণীর মধ্যকার ঐতিহ্যিক অন্তর্কলহ এক যাদুকরী আপস রফায় মিটল বটে- কিন্তু চরকে নিয়ে দ্বনদ্ব-মাত্রা ও গুণ উভয় দিক থেকেই লাভ করল ভিন্ন তাৎপর্য। প্রাক-ধনতান্ত্রিক যুগের প্রতিভু যন্ত্রকলের মালিক ও অর্থশক্তিতে করায়ত্ব করে নিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়কে। কালিন্দীর চরে স্থাপিত হলো নতুন যুগের যন্ত্রকল। কৃষিজীবী সাঁওতালরা পরিণত হলো শ্রমদাসে। স্বর্ণপ্রসবিনী কালিন্দীর চর বিমলবাবুর কুক্ষিগত হলো। উপন্যাসের শুরুতে যে দ্বনদ্ব ছিল সামন্ত সমাজের অভ্যন্তরীণ কলহের মধ্য সীমাবদ্ধ, মধ্য পর্যায়ে তা দুই অর্থনৈতিক শ্রেণীর পরস্পর সংঘাতে রূপ নিল। আর উপান্তে-তারাশঙ্কর প্রতিষ্ঠা করলেন অমোঘ সমাজসত্য। এ পর্যায়ে লক্ষ্য করি কালিন্দীর চরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাক-ধনিক যুগের প্রতিভু বিমলবাবুর যন্ত্রপুরী। উচ্ছেদকৃত সাঁওতালরা বাধ্য হয়েই প্রত্যাবর্তন করে তাদের অতীত যাযাবর জীবনে। তবে সমাজপতির এই ধারাক্রমকে একটি ইঙ্গিতময় তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী হয়েছেন ঔপন্যাসিক।

'গণদেবতা - পঞ্চগ্রাম' উপন্যাসে দ্বারক চৌধুরীর ট্রাজিক পরিণতিতে কিংবা হিরু পালের শ্রীহরি ঘোষরূপে অবিশ্বাস্য গোত্রান্তরে তারাশঙ্কর এ সত্যই প্রকাশ করেছেন। সংগৃহীত অগাধ বিত্ত এবং সে সূত্রে অর্জিত অমিত প্রতাপই বর্ণগত শ্রেণীভেদের মূলে আঘাত হানতে হিরু পালকে প্ররোচিত করেছে। তারাশঙ্কর বোঝাতে চেয়েছেন অবক্ষয়- উন্মুখ সমাজে যে নবপ্রেরণা ক্রমশঃ সঞ্চারিত হচ্ছে, তার নিয়ামক অর্থ বা বিত্ত। সামন্ত-সমাজের রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় অর্থ ও অর্থনীতির ভূমিকা এভাবেই গণদেবতা- পঞ্চগ্রামে শিল্পের অবয়ব সন্ধান করেছে।

'হাঁসুলী বাঁকের উপকথায়' তারাশঙ্কর কৌম সমাজের গোষ্ঠীজীবনকে বিষয়ভুক্ত করেছেন। উপন্যাসটিতে রয়েছে সমান্তরাল দু'টি কাহিনী স্রোত। একটি- বাঁশবাঁদি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কোপাই নদীর বিখ্যাত হাঁসুলী বাঁকের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন সংহতির অনিবার্য ভাঙন, কৃষি নির্ভর জীবনের ক্রমাবসান এবং বাঁশবন- ঘেরা উপকথার হাঁসুলী বাঁকের বিরান প্রান্তরে পরিণত হওয়ার কথকতা।

তারাশঙ্কর দেখাতে চেয়েছেন হাঁসুলী বাঁকের গোষ্ঠী জীবনের বিনাশের ইতিহাস অর্থাৎ মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং পরিণতিতে কাহার সম্প্রদায়ে স্বগ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ার প্রসঙ্গ। উপন্যাসে দেখি, যুদ্ধের দামামাই নগদ অর্থ উপার্জনের প্রলোভনে আকৃষ্ট করে কাহারদেরকে দিনমজুরে পরিণত করেছে, যুদ্ধের রসদ যোগানোর অনিবার্যতায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে বাঁশবাঁদির বাঁশবন। ফলত, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কাহারকুল; বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের অজগরতুল্য জঠরের আকর্ষণে বাস্তুহারা- সংস্কৃতিহারা কৃষক কাহার রূপান্তরিত হয়েছে যন্ত্রকলের শ্রমদাসে।

তিনি অনেক গল্পও লিখেছেন।  বেদে,  পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার,  বাগদী, বোষ্টম,  ডোম ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র তাঁর গল্পে দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। ‘রসকলি’, ‘বেদেনী’, ‘ডাকহরকরা’ প্রভৃতি তাঁর প্রসিদ্ধ  ছোটগল্প। তাঁর 'দুই পুরুষ', 'কালিন্দী', 'আরোগ্য নিকেতন' ও 'জলসাঘর' অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। 

সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৪৭) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৬) লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। 

তার এই সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যেকে এক নতুন দিশায় নিয়ে এসেছে। তার উপন্যাসে বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে - ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসে ফুটে উঠেছে খুব গুরুত্বের সহিত। মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসে  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। মহান এই সাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে যে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকট মুহূর্তে বাংলা কথাসাহিত্যে যে ক’জন লেখকের হাত ধরে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত তাদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের  মধ্যে  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন। নিচে তার পরিচয় ও উপন্যাসে অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :

জন্ম : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনার বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। জন্মপত্রিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অর্ধচন্দ্র। তাঁর পিতার দেওয়া নাম ছিল - প্রবোধকুমার আর ডাকনাম - মানিক। 

পিতা : হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা : নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাবরেজিস্ট্রার।

পিতার চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি নিয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।

শিক্ষাজীবন : তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৬ সালে ‘মেদিনীপুর জেলা স্কুল’ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ’ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে ‘কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে’ গণিত বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। তবে তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি। 

কর্মজীবন : শিক্ষা জীবনের ডিগ্রি অর্জন করতে না পারা মানিক বন্দোপাধ্যায় কিছুদিন 'নবারুণ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তী কালে 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৪৪ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ সময় থেকে তাঁর লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৯৪৬ সালে প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

সাহিত্যকর্ম : জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এছাড়া মার্ক্সবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তরাধিকারী। তাঁর প্রথম গল্পগুচ্ছ ‘অতসী মামী’ ও অন্যান্য সংকলনে সবকয়টি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। এছাড়া গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবনচিত্রও তাঁর বেশকিছু লেখায় দেখতে পাওয়া যায়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণ-বঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রের আড়ালে। অদ্ভুত নিরাসক্তভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধি ও লেখনীতে। নর-নারীর জৈবসত্তা বিকাশের নানাদিক তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর লেখায় জৈবসত্তা ও দৈহিক বর্ণনা কিছুটা বেপরোয়া প্রকৃতির।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। ফলে তিনি জীবনের দিকটি দেখতেন তার সমগ্রতায়, খণ্ড খণ্ড করে নয়, অখণ্ডতায়। তিনি যেমন ফ্রয়েডীয় মতবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি জীবনের, মনুষ্য জীবনের মুক্তি দেখেছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদই তাকে দীক্ষা দেয়। এই মতবাদেই তিনি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে বিশ্বাস পোষণ করেন, তাই তাঁর সাহিত্য জীবনের পাথেয়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো 'দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), 'শহরতলী' (১৯৪০-৪১), 'প্রতিবিম্ব' (১৯৪৩), 'দর্পণ' (১৯৪৫), 'চিহ্ন' (১৯৪৭), 'চতুষ্কোণ' (১৯৪৮), 'অহিংসা’ (১৯৪৮) 'সার্বজনীন' (১৯৫২), 'আরোগ্য' (১৯৫৩) ‘ প্রভৃতি। 

শক্তিমান এই লেখকের অমর কীর্তি 'জননী' নামের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শ্যামা নামে এক গৃহবধূর জননী সত্ত্বার বহুবিধ আত্মপ্রকাশ এই উপন্যাসের উপজীব্য। উপন্যাসে লেখক জননী চরিত্রটিকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করেননি। বরং এক জননীর কাহিনী বাস্তবতার আয়নায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাস বললে বরং ভুলই হবে, এ যেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চিরন্তন ঘটে যাওয়া মানব জীবনের চক্রেরই স্বার্থক খণ্ডচিত্র।

'পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনায় বস্তুবাদী শিল্পস্রষ্টা নন, তিনি এই উপন্যাসে অনেকখানি অন্তর্বাস্তবতার শিল্পী। প্রমাণ উপন্যাসের চরিত্রের মনো-বাস্তবতা যেমন আছে, তেমন আছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ রসহ্যময়তার মধ্যেও। এই উপন্যাসে তিনি সব সময়ে বৈজ্ঞানিক বোধের পরিচয় দিয়েছেন এবং মানুষের জয়গান গেয়েছেন শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শশী যদিও শেষ মুহূর্তে নিজেকে পুরুষ বা প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি, তবুও কুসুমকে তিনি নারীর  চেয়েও মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন। গোটা উপন্যাসে একজন কুসুম, গ্রামীণ নারী- সকল তীর্থ দুয়ার ভেঙ্গে একজন শশী ডাক্তারের কাছে নিজেকে নিবেদন করেছিল, কাল বা সময় বিবচেনা করলে, কুসুম অনেক সাহসী মানুষ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে সবসময়ে নারীর মধ্যে মানুষের সত্ত্বা আবিষ্কার করার প্রবল আকাঙ্খা দেখতে পাই। যেমন দেখি, জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’র অতসী মামীর মধ্যে।

'শহরতলী’ উপন্যাসে তিনি মধ্যবিত্ত-সুলভ দোদুল্যমানতাকে তীব্রভাবে আঘাত করেছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনি নিজেও ঘৃণা করতেন। তারপরও যশোদার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তবে তা মালিক শ্রেণির কূটকৌশল এবং শক্তি প্রদর্শনের জন্য। তবে শ্রমিকশ্রেণির শক্তিও সংহত হয়েছে। মালিকশ্রেণি বুঝেছে এ শ্রেণিরও শক্তি রয়েছে। এ উপন্যাসে তিনি শ্রমিক শ্রেণির শক্তির সম্ভাবনাকে যাচাই করে নিয়েছেন। 

‘অহিংসা’ উপন্যাস রাজনৈতিক কি অরাজনৈতিক তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু এ উপন্যাসে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে, এ অহিংস নীতির কারণে সত্যও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত হয়েছে ‘প্রতিবিম্ব’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যের কথা ব্যক্ত হয়েছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়েছে ‘দর্পণ’ উপন্যাসে। তারাশঙ্কর যেমন ‘পঞ্চগ্রামে' কংগ্রেসের ব্যর্থতা দেখিয়েছেন তেমনি বামপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতাও চিহ্নিত হয়েছে ‘প্রতিবিম্ব’ উপন্যাসে। যারা ‘সোভিয়েত পোস্টার’ দেখেন কিন্তু নিজ দেশের মানুষদের ভাল করে জানেন না তিনি তাদের সমালোচনা করেছেন। আবার এ দুর্বলতা অতিক্রমণেও তিনি বিশ্বাসী। 

‘চিহ্ন' উপন্যাসে তিনি বিপ্লবী শক্তির সম্মিলিত রূপ দেখিয়েছেন। পাশাপাশি সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।এখানে সবাই এক সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এমনকি এ উপন্যাসে নির্দিষ্ট করে নায়ক-নায়িকাকেও চিহ্নিত করা যায় না। মনে হয় সবাই এক হয়ে গেছে এবং সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ উপন্যাসে কৃষক-শ্রমিকে বিরোধ নেই বরং কৃষক নিজেকে শ্রমিক ভাবছে আবার শ্রমিকও একাকার হয়ে যাচ্ছে কৃষকের সঙ্গে। 

‘প্রতিবিম্ব’ উপন্যাসে আত্মকেন্দ্রিক তারককে দেখেছি কিন্তু 'অহিংসা' উপন্যাসে যাদব আর শেষ পর্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক থাকেনি, সে সংগ্রামীদের একজন হয়ে উঠেছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, উপন্যাসকে করেছে প্রাণবন্ত। বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্রের সমগ্রজীবন কেটেছে ভীষণ কষ্টে। ১৯৩৫ সাল থেকে মানিক মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা পরবর্তীকালে জটিল অবস্থায় গমন করে। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন বাংলা কথাসাহিত্যের এই ধ্রুপদী।

ফলে পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়  বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছে। তাঁরা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন নতুন সুর, নতুন মাত্রা। তাঁরা বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধ এবং উপন্যাসকে করেছে প্রাণবন্ত।  তিনজনের জগৎ আলাদা হলেও  শক্তিতে তারা স্বগোত্রীয় ছিলো। বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে তাঁরাও অমর হয়ে থাকবে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। 

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.